তুমি তো আমাকে চেনো…
প্রথম ভাগঃ প্রারম্ভিকা
জানোই তো, ঘুম হল এক ধরনের প্রতারণা। ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নিতে তুমি চোখটা বন্ধ কর, ধীরে ধীরে তোমার শরীর শিথিল হতে শুরু করে। হৃৎস্পন্দন কমে আসে, কমে আসে শরীরের তাপমাত্রা। তুমি তখন নিজেকে নিরাপদ ভেবে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে শুরু কর।
আর ঠিক সেই সময়টাতেই তোমার বুকের উপর এমন কিছু একটা উঠে বসে, যার অস্তিত্বের কথা তোমার জানা নেই! তবে আমি জানি, কারণ আমি তো সেটা দেখেছি। আচ্ছা চল, তোমাকে আমার ঘটনাটা বলি, তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে আমি কীসের কথা বলছি।
প্রথম রাতে আমি শুধু একটা মৃদু শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। শব্দটা মৃদু হলেও তার তীক্ষ্ম একটা অনুভূতি আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। নিঃশ্বাসের শব্দ ছিল সেটি। অন্ধকারে, ঠিক আমার বিছানার কোণ থেকে শব্দটা হয়েছিল। কেমন একটা ঠান্ডা, গভীর, লম্বা একটা টান। আমি ভেবেছিলাম মনের ধোঁকা হয়তো, এত রাতে একা ঘরে কার নিঃশ্বাসের শব্দ হবে!
দ্বিতীয় রাতেও আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল, খুব অস্বস্তি লাগছিল। ওটা তখন আমার বুকের উপর বসে আছে। নড়তে পারছিলাম না, শ্বাসও নিতে পারছিলাম না। শুধু অনুভব করছিলাম সেই ঠান্ডা নিঃশ্বাসের মতই- ঠান্ডা, ভেজা হাতটি গলার চেপে ধরে আছে। চাপটা খুব অদ্ভুত, না শক্ত – না নরম; তবে ততটাই, যতটা থাকলে পরে তোমাকে আতঙ্ক আঁকড়ে ধরে।
দিনের আলোতে এই কথাগুলো নিজের কাছেই হাস্যকর লাগছিল। বিশ্বাস কর, মাকে গিয়ে যে কথা গুলো বলব, আমার তো নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল ছ’বছরের বাচ্চারা রাতে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে যা করে, আমিও তেমন করছি।
তৃতীয় রাতেও আমি সেই ঠান্ডা হাতের অনুভব পেলাম। আমি ঠিক-ঠিক গুনে ফেললাম- সেখানে মোট ছ’টা আঙ্গুল আছে। তিনটা বামে, আর তিনটা ডানে। বরফ শীতল আঙ্গুলগুলো যেন গলার চামড়া ফুড়ে মেরুদন্ড ছুঁয়ে দিতে চাইছে!
তারপর, চতুর্থ রাত, আমি বুঝলাম ও আমাকে ডাকছে। ওকে আমি ঠিক দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু ওর কণ্ঠটা যেন আমার মস্তিষ্কের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছে। বলছে- ‘তুমি তো আমাকে চেনো….’
পরদিন সকালে মা আমাকে ডাকতে এসে দেখলেন, আমি চুপচাপ শুয়ে আছি। ডাক্তার বলল- ‘হার্ট অ্যাটাক’। সবাই সেটা বিশ্বাসও করে নিল। অথচ, আমি সেখানেই ছিলাম, আয়নাটার সামনে। যেখান থেকে আমি সেই ছায়াটাকে ধীরে ধীরে সরে যেতে দেখছিলাম, আর তার দৃষ্টি ছিল… থাক সে কথা।
এর ক’দিন বাদেই ওরা সবাই বাড়িটা খালি করে কোথায় যেন চলে যায়। আমি ওদের দেখেছি, ওরা ঘরের আসবাবপত্র বের করছে, সামানা গোছাচ্ছে, ভ্যানে ভরছে। কিন্তু ওরা আমাকে দেখে না। জানালা দিয়ে আমি কেবল ওদের চলে যাওয়াটুকুই দেখলাম। এরপর থেকেই আমি একা, একদম একা।
⠀⠀⠀
⠀⠀⠀
দ্বিতীয় ভাগঃ বাড়ির নতুন বাসিন্দা…
শহর ছেড়ে এই গ্রামে এসেছি দিন দশেক হয়েছে। একটা প্রজেক্ট চলছে এখানে, আরও কয়েক মাস চলবে। প্রথম কয়েকদিন তো এখানকার কাজ-কর্মের কোন আগা-মাথা বুঝে পাচ্ছিলাম না। সবই চলছে নিয়ম মাফিক, আবার সবই এলোমেলো। সে সব গোছাতেই চলে গেছে এই কয়েকদিন। হেড অফিস থেকে জানাল, তারা এখানে নতুন কাউকে পোস্টিং দিবে বলে ভাবছে। তবে সেটা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে একটু কাজগুলো গুছিয়ে দিতে বলল।
শহরের বাইরে আমার তেমন করে কখনো থাকা হয়নি। এখন এই কাজের কারণে না আসলে হয়ত এভাবে এতদিনের জন্যে আসা হতো না। শহরেই জন্ম, বেড়ে উঠা, আর শহরেই জীবনটার ইতি হতো। সারাদিন ভালোই কাটে, কাজের ব্যস্ততায়, সাইট ঘুরে দেখে। কিন্তু বিকেলের পর আর সময় কাটতে চায় না। তার উপর এমন একটা জায়গায় থাকবার ব্যবস্থা হয়েছে! ছোট একটা একতলা বাড়ি, একদম গ্রামের সীমান্ত ঘেঁষে। বাড়িটা অফিসের, এখানে তারা অন্য একটা প্রজেক্টের জন্য জমি কিনার সময় খুব কম দামে পেয়ে যায়, তাই কিনে নেয়। কারও থাকার উদ্দেশ্য না হলেও এখন এই প্রজেক্টের জন্যে আমার থাকার জায়গা হয়েছে।
ছিমছাম শান্ত পরিবেশ ঘেরা, ঝুপ করে সন্ধ্যা নামার পর নাম না জানা পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। এখানকার ম্যানেজার প্রথমে তার বাসাতেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার কারও বাসায় এভাবে থাকাটা পছন্দ হচ্ছিল না, তাই সেটা বাতিল করেছিলাম। এরপর তিনি একপ্রকার জোড় করেই খাবারের ব্যবস্থাটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন। এখন টিফিন কেরিয়ারে করে সন্ধ্যার পরপর খাবার চলে আসে তার বাড়ি থেকে। তবে এক ফাঁকে তিনি আমাকে জানালেন, এই বাড়িটার ব্যাপারে কিছু আজেবাজে কথা শোনা যায়। যদিও বিশ্বাস করার মত তেমন কোনো ভিত্তি নেই। তারপরও রাতে বাড়ি থেকে বের হতে বারণ করলেন। আর কোনো সমস্যা হলে যত রাতই হোক, তাকে যেন নির্দ্বিধায় ফোন করে জানাই -সে আশ্বাস আদায় করে নিলেন।
দিনভর দৌড়োদৌড়ির পর শান্ত পরিবেশ আর পেট পুরে খানা পেয়ে এখন ঘুমও চলে আসে দ্রুত। বড় জোড় রাত ১০টা পর্যন্ত জাগে থাকতে পারি, তারপর টুপ করে ঘুম ধরে বসে। অবশ্য আমিও যে খুব জেগে থাকতে চাই, তা না। সকাল সকাল খুব ফ্রেশ একটা ভাব চলে আসে এত লম্বা ঘুম পেয়ে। দিনের ক্লান্তিটা তখন আর তেমন গায়ে লাগে না।
এগারো তম রাতে হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল, ঠিক বোঝানোর মত না। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এসেছে। জানালার ফাঁকা দিয়ে ফ্যাকাশে চাঁদের আলো এসে বিছানার একপাশে থেমে আছে। মনে হচ্ছে যেন সময়টাও আটকে গেছে। অস্বস্তিটা আমাকে এমনভাবে ঘিরে ধরেছে যে, উঠে বসে টেবিল থেকে মোবাইল বা ঘড়িটা পর্যন্ত নিতে ইচ্ছে হলো না। বেশ অনেকটা সময় পর হঠাৎ করেই সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। যেন কেউ রিমোট থেকে প্লে বাটনে চাপ দেয়ার সাথে সাথেই সব আগের মতই চলতে শুরু করেছে। অস্বস্তিটাও কেটে গেল প্রায় সাথে সাথেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আবার ঘুমের সাগরে ডুবে গেলাম।
পরদিন আর এটা নিয়ে তেমন কিছুই মনে থাকলো না। সাইট ঘুরে কাজ দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল।
সমস্যাটা হলো আবার রাতে। গতদিনের মতই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। ঠিক ভেঙ্গে গেল কিনা সেটাও নিশ্চিত করে বলতে পারছিলাম না। যেন ঘুমের গভীর কোন স্তরে ডুবে আছি, কোন নড়াচড়া কিংবা সাড়াশব্দ কিচ্ছু নেই। কেবল একটা চাপা অস্বস্তি।
হঠাৎ বুকের উপরে ভারী আর ঠান্ডা একটা চাপ অনুভব করলাম। কারও উপস্থিতি… না, কারও বসে থাকা। শরীর শক্ত হয়ে গেছে, আঙুল পর্যন্ত নড়ছে না। চিৎকার করতে গেলেও শব্দ বের হচ্ছিল না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।
তারপর ঠান্ডা, ভেজা একজোড়া হাত গলার দুই পাশে চেপে ধরলো। এমনভাবে চাপ দিচ্ছিল- যেন নিখুঁতভাবে আমার শ্বাস বন্ধ করতে চাইছে। চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসছে, মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। আর কানের ভেতর একটা ফিসফিসানি- “তুমি তো আমাকে চেনো…”
আজকের পূর্বে আমার নিজেকে কখনো ভীতু মনে না হলেও, আজ আমার বুকের ভেতর ভয় ভয় জমে বরফ হয়ে গেল। হঠাৎ মনে হলো নিঃশ্বাসও নেওয়ার দরকার পড়ছে না। গলার চাপ কমেনি, বরং বেড়েছে বলা যায়। অথচ শ্বাস টানার কোন আকুতি আর ফুসফুস করছে না। হয়ত অক্সিজেনের অভাবে উল্টোপাল্টা ভাবছি। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছি যে মস্তিষ্ক পরিষ্কার চিন্তা করতে পারছে। আর প্রশ্নটা নিজে থেকেই এলো- তবে কি আমি মারা গিয়েছি? নাকি এটা পুরোপুরি কল্পনা? অথবা এই অনুভূতিটাই মৃত্যুর পরের অংশ?
পরের মুহূর্তেই উঠে বসলাম। বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু ঘরের পরিবেশ একদম স্বাভাবিক। জোরে জোরে ফুসফুস ভরে শ্বাস নিচ্ছি, বা হাঁপাচ্ছি। বিছানাটা এলোমেলো, চাদর গুটিয়ে গেছে।
নামলাম বিছানা থেকে, হেঁটে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম। একটু আগে যে আতঙ্ক ভর করেছিল, তার ছিটে-ফোটাও লাগছে না এখন। উলটো নিজেকে যেন আরও হালকা লাগছে। বেসিনের ট্যাপ ছেড়ে চোখে-মুখে ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে দিলাম। মাথা কিছুটা পরিষ্কার হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বোকামিতে হেসে ফেলতে গেলাম,কিন্তু হাসি মিলিয়ে গেল পরের সেকেন্ডেই।
গলার দুই পাশে তিনটা করে সমান লালচে দাগ। যেন কারও আঙুলের চাপের ছাপ। আমি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম, হালকা গরম, কিন্তু কোনো ব্যথা নেই। আমার আতঙ্কিত হওয়ার কথা, কিন্তু তেমন কোন অনুভূতি হচ্ছে না। যেন এমনটা হবে আমি জানতাম!
এরপর আর ভালো ঘুম হলো না। বারবার কেবল ঘুরে ফিরে ঐ ফিস্ফিস শব্দটা মাথায় চলে আসছিল। “তুমি তো আমাকে চেনো…”
পরদিন সকালে অফিসে গিয়েই এখানকার ম্যানেজার সাহেবকে জানালাম জরুরি কাজে বাড়ি যাচ্ছি। হাতের কাজগুলো তাকে বুঝিয়ে দিয়েই গাড়িতে উঠলাম। হেড অফিসে কেবল অসুস্থতার ছুটির জন্য একটা মেইল পাঠিয়ে রাখলাম।
আট ঘণ্টার জার্নি দিয়ে ফিরলাম বাসায়। আমার কেবল মনে হচ্ছিল আমাকে যে করেই হোক ঐ জায়গাটা ছেড়ে আসতে হবে। তাই আর সামনে-পেছনে কোন কিছুই চিন্তা না করে সোজা বাসায় এসেছি। অবশ্য বাসায় এসে কাউকে কিছু বলে ভরকে দিতে ইচ্ছা হল না। ছুটি নিয়েছি, জানালাম কেবল। ওরা ভাবল, এভাবে হঠাৎ করেই শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে থাকা, আর লম্বা জার্নির কারণে আমাকে এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
ফ্রেশ হয়ে কোনোরকম রাতের খাবার শেষ করেই আমার রুমে গিয়ে ঢুকলাম। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুম ঘুম ভাব চলে আসল। অনিচ্ছাতেও গভীর ঘুমে নিপতিত হতে থাকলাম।
⠀⠀⠀
⠀⠀⠀
তৃতীয় ভাগঃ অবশেষ…
একটা ঘোরের মন লাগছে। মনে হচ্ছে জেগে আছি, আবার মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। বিছানায় উঠে বসতেই আলমারির আয়নার দিকে চোখ পড়ল। পেছনে বাথরুমের দরজা আধখোলা, আর তার ফাঁক দিয়ে মনে হলো কেউ দাঁড়িয়ে আছে- অস্পষ্ট, ছায়ার মতো।
আমি চোখ মুছলাম, আবার তাকালাম- কই? কেউ তো নেই!
হঠাৎ বাতাস থেমে গেল। না, আসলে বাতাস নয়, নিশ্বাস নেয়ার আকুতি; থেমে গেলো।
আয়নার ভেতরে আমার পেছনে অন্ধকার জমতে শুরু করলো। প্রথমে মনে হলো ছায়া, কিন্তু তা ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে- লম্বা, কঙ্কালসার হাত… প্রতিটি হাতে তিনটি লম্বা আঙুল।
আমার কাঁধের উপর দিয়ে সেই হাতের ছায়া এগিয়ে এলো। আয়নায় হাত দেখা গেলেও আমার গায়ে কোন কিছুর ছোঁয়া অনুভব করলাম না। আমি স্থির হয়ে রইলাম, চোখের পাপড়িও ফেলতে পারছি না।
তারপর সেই ছায়ার মাথাটা ঝুঁকে এল আমার ঠিক কানের পাশে। কোনো ঠোঁট নড়ছে না, কিন্তু এক বরফশীতল ফিসফিসানি মাথার ভেতর এক স্বরে বলেই চলেছে- “তুমি তো আমাকে চেনো…”
আমি তখন আয়নার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম প্রতিফলনে দাঁড়িয়ে থাকা আমিটা আসলে আমি নই। প্রতিফলনের চোখ গাঢ় কালো হয়ে গেছে, ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি, আর গলার দাগগুলো রক্তিম লাল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। ওটা আমাকে দেখছে… কিন্তু আমি ওটাকে… কি জানি!
বাথরুমের দরজা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকার পুরো ঘরটাকে গিলে নিল।
⠀⠀⠀
⠀⠀⠀