হসপিটালের ওয়েটিং রুম: ধৈর্য, অপেক্ষা আর জীবনের শিক্ষা

দুটি দরজা, একপাশে কান্নার আওয়াজ আর অন্যপাশে আনন্দের হর্ষধ্বনি। আর এদের মাঝে একটি রুম, নাম তার ‘ওয়েটিং রুম।’ যেখানে সময়ের ঘড়ি চলে ধীরগতিতে, অথচ হৃৎস্পন্দন পাগলা ঘোড়ার দ্রুতিতে ছোটে। জীবনের এই দেনা-পাওনার মঞ্চে হাসপাতাল হল সেই স্থান, যেখানে প্রতিটা মিনিটের আলাদা রঙ আছে, প্রতিটা শ্বাসের রয়েছে আলাদা অর্থ।

চেয়ারে অপেক্ষমাণ মানুষগুলোকে দেখলে বোঝা যায়, অপেক্ষা কেমন করে তাদের উৎকণ্ঠাকে মুখভঙ্গিতে টেনে উঠিয়ে নিয়ে আসে। কারও চোখে ভয়ের কুয়াশা তো কারও ঠোঁটে নীরব প্রার্থনা, কারও হাতে প্রেসক্রিপশন চেপে ধরা তো কারও চোখে-মুখে অদৃশ্য শূন্যতা। কোণায় কোণায় অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধ, দেয়াল ঘড়ির টিকটক-টিকটক শব্দ, ব্যাস্ততায় মুখ ভরা এটেন্ডেন্ট; পুরোটা দেখলে মনে হয় কেউ যেন সময়কে ধীর করে এসবের মাঝে পেঁচিয়ে দিয়েছে। কারও কাছে পাঁচ মিনিট এখানে অসহ্য অনন্ত, আবার এই পাঁচ মিনিটই কারো কাছে জীবনের নতুন সূর্যোদয়ের অংশ।

এখানে ডাক্তার সাহেবের চেম্বারের দরজার দুই প্রান্তে দুইটি আলাদা জগৎ রয়েছে। চেম্বারের ভেতরে প্রবেশ করা রোগীটি মনে করে— ডাক্তার সাহেব কি ঠিকমতো আমাকে দেখছেন? এই যে দ্রুত কয়েকটা প্রশ্ন করে, দ্রুত কয়েকটা পরীক্ষা করাতে দিলেন, নাম না জানা কতোগুলো ঔষধের নাম লিখে দিলেন; এগুলোই কি যথেষ্ট? আবার বাইরে বসে থাকা মানুষটি ভাবে- একজনকে দেখতেই এত সময়! আমার সিরিয়াল কি আজ আসবে? একই সময়ে দুই বিপরীত প্রত্যাশা নিয়ে সবাই এখানে অপেক্ষা করে। কেবল নিজের সমস্যাটার বেলায় খুব মনোযোগ প্রত্যাশা করে, আর অন্যদের বেলায় কেবল বিরক্তির প্রকাশ করে। ওই একই মানুষ, একই ডাক্তার- শুধু দরজার দুই পাড়ে দাঁড়াতেই আমাদের চাওয়া-পাওয়া এখানে ভিন্নরূপ ধারণ করে।

প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ডাক্তার সাহেব কেমন যেন উদাসীন, আমার পুরো কথা শুনলেন না বা সবকিছু জিজ্ঞাসা করলেন না, ভালোভাবে বুঝলেন না। তাহলে কী তারা উদাসীন?!! মোটেই না, বরং দিনের পর দিন একই রকম উদ্বেগ, একই রকম ব্যথা, একই ভঙ্গির উৎকণ্ঠা, একই রকম জরুরি অবস্থা সামলাতে সামলাতে তাঁদের মুখে হাসির বদলে নিয়ম বাসা বেঁধেছে। রুক্ষ বা রুষ্ট নয় বরং এটি দায়িত্ব পূরণে আত্মরক্ষার এক পাতলা আস্তরণ; যেন আবেগে ভেসে গিয়ে হাত কাঁপে না, সিদ্ধান্ত নিতে মনে যেন কোন দোদুল্যমান অবস্থার উদ্রেক না ঘটে। একই ঘটনা ঘটে নার্সদের ব্যাপারে, তাদের রুক্ষ আচরণ আর কঠিন ব্যবহার নিয়ে আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই। অথচ নার্সরা যেই রুক্ষ আচরণটি করে, যে “রুটিন” মেনে চলে, সেটাই তো আপনার-আমার জন্যে নিরাপত্তার ব্যারিকেড। কখন ইনজেকশন, কখন স্যালাইন, কোন ওষুধ আগে, কার প্রেসার নেমে যাচ্ছে -এসব সমীকরণের হিসেব মেলাতে একটু ঘাড় নেড়ে সান্ত্বনার প্রকাশ কিংবা আপনার অন্যায়কে প্রশ্রয় না দিয়ে তারা আপনাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।

হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে কিছু সময় ব্যয় করলে জীবনকে অন্য আলোয় দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। পাশের চেয়ারে হয়ত নতুন বাবার কাঁধে লেপটে থাকা খুশি; একটু দূরে স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা এক বৃদ্ধার নিঃশব্দের টানা শ্বাস; কেউ চুপচাপ তসবিহ গুনছেন, কেউ ফোনে টাকার বন্দোবস্ত করছেন, কেউ রিপোর্টের শিরোনাম ধরে ধরে গুগল করা শব্দের মানে খুঁজছেন। এইসব দৃশ্যের ভিড়ে বোঝা যায়- আমাদের ব্যক্তিগত ঝড় গুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলোচ্ছাস নয়। বরং আজ যে যন্ত্রণায় বুক ফেটে যাচ্ছে, কালই হয়ত বুঝব আমার সেই কষ্টটা আসলে তেড়ে আসা সমুদ্র নয়, বরং সেটি ছিল সমুদ্রতীরের কেবলই ছোট্ট একটা ঢেউ।

আমরা মানুষেরা খুবই ‘আপন কেন্দ্রিক’। নিজের বেলায় পরিপূর্ণ আকর্ষণ কামনা করি, আর পরের বেলায় খানিকটা আকর্ষণেও বিরক্তি প্রকাশ করি। অথচ হসপিটালের এই একটি কাঠামোতেই হাজার হাজার গল্প একসঙ্গে ঘটে। এখানে কারও একজনের বিলম্ব অন্য কারও বেঁচে উঠার কারণ হয়ে উঠে। এখানে একজনের একটু অপেক্ষা অন্য কারও জন্যে জীবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সিঁড়ির একটি ধাপ হয়ে উঠে। এখানে সময় সমান্তরাল লাইন না হয়ে বিপ-বিপ শব্দ তোলা বাঁকা-তেড়া সাইন হয়ে উঠে। কপালের চিন্তার ভাজ আর গালে খুশির টোল এখানে একইসঙ্গে ঘটতে থাকে।

শিষ্টতা, সহানুভূতি, সম্মান আর দায়বদ্ধতার এক দারুণ হারমোনি দেখা যায় হাসপাতালগুলোতে। নিজের ব্যক্তিগত বিরক্তি ঢেকে ডাক্তার সাহেব হাসিমুখে আপনার সমস্যাটি যখন জানতে চায়, তখন প্রকাশ পায় তার শিষ্টতা, রাত তিনটার ডিউটিতে বারো ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়া নার্সের হাত যখন নিখুঁতভাবে ক্যানোলা বসায়, সেটাই তার সহানুভূতি; দীর্ঘ লাইনের মাঝেও যখন ডাক্তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো পরীক্ষা লেখেন না, সেটাই তার দায়বদ্ধতা; ডায়াগনোসিস ঠিক রাখতে যখন তিনি আপনাকে পঁচিশটা প্রশ্নের বদলে সঠিক পাঁচটা প্রশ্ন করেন, সেটাই আপনার প্রতি দেখানো তার সম্মান। এই বিষয়গুলো অনুধাবনের, অনুকরণের। মমতা সবসময় হাসি দিয়ে নয়, অনেকক্ষেত্রে নীরব নির্ভুলতার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকে।

তবুও অভিযোগ থাকবে; হাসপাতাল মানেই কাগজপত্র, বিল, সিরিয়াল, ভিড়, হুলস্থূল, দিশেহারা অবস্থা। আমরা চাই মানবিকতা; সিস্টেম চায় শৃঙ্খলা। এই দুইয়ের মাঝখানে একটা সেতুবন্ধন প্রয়োজন। প্রয়োজন অপেক্ষার প্রতি সম্মান এবং সেবার প্রতি আস্থা। আমরা যদি প্রয়োজন আর প্রশ্নগুলোকে ভাগ করতে পারি, জিজ্ঞাসা আর চাহিদাকে সময়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করতে পারি তাহলেই ব্যাপারগুলো সহজ হয়ে উঠে। আর অন্যদিকে কাউন্টারের অপরপাশ থেকে কেউ যখন বলবে- “একটু অপেক্ষা করুন, আপনারটা আমরা দেখছি।” তখন অপেক্ষার ভারী বাতাস হালকা হয়ে উঠে। আপনি-আমি, ডাক্তার-নার্স – সবাই মিলে চাইলেই এই সেতুটি বানাতে পারি।

সবশেষে, ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে যখন করিডর ধরে এগোতে শুরু করবেন, তখন একবার পিছনে তাকান। দেখবেন, আপনার ঠিক পরেই আরেকটি গল্প সেই একই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেউ হয়ত ফোনকলে নিজের আনন্দটা প্রকাশ করছে; কেউ চুপচাপ বসে কাঁদছে; কেউ একে অপরের কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিচ্ছে। এই ধারাবাহিকতার নামই তো জীবন। কেউ হারায়, কেউ পায়; কেউ শিখে নেয় স্থির হতে, কেউ পায় কৃতজ্ঞ হওয়ার মন্ত্রণা।

সময়কে মানতে আর মানুষকে বুঝতে শেখায় হসপিটাল। সময়কে মানলে অপেক্ষা সহনীয় হয়; মানুষকে বুঝলে অভিযোগ হয় সংক্ষিপ্ত। পরের বার আপনি যখন ওয়েটিং রুমে বসবেন, বিরক্তিটাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলবেন। গভীর একটি শ্বাস নেবেন, আর মনে মনে বলবেন—”এটা কেবল একটি জার্নি, ধৈর্য আর অপেক্ষাই আমাকে পৌঁছে দেবে গন্তব্যে।” দেখা যাবে, একই ঘড়ির কাটাও তখন একটু টিক-টক শব্দ করে এগিয়ে যাবে, কিন্তু এবার সেই সুরটি বিরক্তির বদলে কোমলতা ছড়িয়ে দিবে।

ওয়েটিং রুমের দরজা পেরিয়ে আমরা আবারও ফিরে যাবো নিজ-নিজ জীবনে। পেছনে থাকবে কর্মব্যস্ত হসপিটাল আর তার ওয়েটিং রুম। তবে ওয়েটিং রুমের সেই শিক্ষাটাও মনে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে- পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কখনও কখনও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা। আরও মনে রাখতে হবে- কোথাও কেউ একজন, এখনো আমাদের জন্যে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। প্রয়োজন কেবল একটু ধৈর্য, একটু আস্থার। বাকি পথ সময় নিজ দায়িত্বে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবে।