কালিধর লাপাতা: বিচিত্র পথে জীবনকে বয়ে বেড়ানোর গল্প…

সম্প্রতি অলস এক সন্ধ্যায় বসে দেখলাম “কালিধর লাপাতা” মুভিটি। মূলত, পা ঝুলিয়ে বসে থাকা মুভির পোষ্টারটি আমাকে এই মুভিটি বেছে নিতে আগ্রহ যুগিয়েছে। তারপর যখন দেখলাম এতে অভিনয় করেছেন অভিষেক বচ্চন তখন আরও কৌতূহল ভরেই দেখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু শেষ হওয়ার পর মনে হল, এটা শুধু একটা চলচ্চিত্র নয়, বরং জীবনের গভীর স্রোত থেকে বলে যাওয়া একটি গল্প ছিল এটি।

মধ্যবয়স্ক এক লোকের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে এই চলচ্চিত্র, যেখানে সে স্মৃতিভ্রংশে ভুগছে, আর তার এই রোগের কারণে চারপাশের দুনিয়া কীভাবে বদলে যায় সেই গল্প থেকেই শুরু। স্পয়লার না দিয়ে বলি, এটা একটা যাত্রার কাহিনি – শারীরিক তো বটেই, মনেরও। আর এই যাত্রায় জড়িয়ে আছে জীবনবোধ, সম্পর্কের জটিলতা আর জীবনের প্রবাহ – যা আমাদের সবার জীবনে কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে আছে।

প্রথমেই বলি জীবনবোধের কথা। মুভিটি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, জীবন আসলে কতটা সরল, অথচ আমরা নিজেরাই তাকে জটিল করে তুলি। কালিধরের চরিত্রটা যেন আত্মভোলা, আত্মত্যাগী মানুষ রূপের একটি আয়না। স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া মানুষের মধ্যে দিয়ে দেখায় যে, মানুষ কত সহজেই লোভের বসে কিংবা প্ররোচনায় পড়ে আপনকে পর করে দিতে পারে। অপরদিকে অতীতের বোঝা ছাড়া বর্তমানে বাঁচতে গেলে কতটা মুক্তি মেলে। আমার মনে হয়, এখানে একটা গভীর বার্তা আছে: জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে, সত্যিকারের বেঁচে থাকা শুরু হয় তখনই যখন অন্যের জন্য বাঁচি। কালিধরের যাত্রায় দেখা যায়, কীভাবে ছোট ছোট আনন্দ, যেমন- গাছের গায়ে লেখা শেষ জীবনের ইচ্ছাগুলো পূরণ করার মাধ্যমে কেউ জীবনকে নতুন করে সাজিয়ে নিতে পারে। এটা যেন আমাদের বলে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুরই শেষ নেই, বরং প্রত্যেকটা শেষই একটা নতুন প্রারম্ভ। আমাদের জীবনেও যদি আমরা এমন একটা ধারণা নিয়ে আসতে পারি তাহলে সেটি আমাদের অন্তরকে কতটা আনন্দ আর শন্তি দিতে পারবে, ভাবুন তো একবার!

এবার সম্পর্কের দিকটা। ছবিটা এখানে খুব সূক্ষ্মভাবে হৃদয় ছুঁয়েছে। কালিধরের পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক দেখে মনে হয়েছে, কতটা সহজেই আমরা প্রিয়জনদের বোঝা ভেবে ফেলি। পরিবারের মধ্যে যে লোভ বা স্বার্থপরতা ঢুকে পড়ে, তা কীভাবে সম্পর্কগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে –এখানে এটা খুবই বাস্তবসম্মত ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অথচ অপ্রত্যাশিত সম্পর্ক কত সহজেই আবার অচেনাকে আপন করে নিচ্ছে। কালিধর আর বল্লুর মধ্যে যে সখ্যতা গড়ে ওঠে, সেটা যেন বলে যে, সম্পর্কের কোনো নাম লাগে না, শুধু নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর সঙ্গ দিলেই হয় তা হয়ে উঠে গভীর বন্ধন। বয়সের ফারাক, নিজেদের জীবনের তফাত –কিছুই বাধা হয় না যদি মনের সাথে মন মিলে যায়। মুভিটা যে এই কথাটাই বলতে চেয়েছে –সম্পর্কগুলোকে জটিল না করে, তাতে স্বার্থ না খুঁজে কেবল হাতে-হাত ধরে একতালে এগিয়ে গেলেই চরম কষ্টেও আনন্দ খুঁজে পাবে।

জীবনপ্রবাহের কথা বলতে গেলে, মুভিটি যেন একটা নদীর মতো বয়ে গেছে। কালিধরের যাত্রা আমাদের জীবনের যাত্রার প্রবাহের সাথে কোথায় যেন মিশে গেছে। ফেলে দেয়ার উদ্দেশ্যকে উল্টে নিজে থেকে হারিয়ে যাওয়া, তারপর নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে তাকে পূরণ করা, পছন্দের খাবারটি খাওয়ার জন্য কখনো কখনো অসম-প্রতিযোগীতায় জুড়ে যাওয়া, বিভিন্ন মোড় থেকে জীবনকে নতুনভাবে দেখতে শেখা, পুরোনো দিনের ফেলে আসা সম্পর্ক গুলোকে পুনরায় ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে যাওয়া -কত ঘটনার প্রবাহেই জীবনে সে জুড়ে নিয়েছে। এই কষ্ট আর এই আনন্দ গুলিই প্রমাণ করে জীবন আসলে এইসব ঘটনাকে পুঁজি করেই এগিয়ে চলে। এই প্রবাহে ভেসে যাওয়া মানে হাল ছেড়ে দেওয়া নয়, বরং স্রোতের সাথে মিশে নতুন পথের খোঁজ করার মানেই জীবন। বিশেষ করে আজকের দ্রুতগতির দুনিয়ায়, যেখানে সবাই ছুটছে; সেখানে এই মুভিটি যেন আমাদের বলছে -থামো, একটু দম নাও, চারপাশটা দেখো, জীবনের ছোট মুহূর্তগুলো উপভোগ করো। জটিলতায় সম্পর্কের হাত গুলো না ছেড়ে বরং তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধর।

সব মিলিয়ে, “কালিধর লাপাতা” আমাকে অন্যরকম ভাবে ভাবিয়েছে। এটা কোনো বড়সড় অ্যাকশন বা রোমান্স নেই সত্যি, কিন্তু এমন একটা উষ্ণতা আছে যা মনকে ছুঁয়ে গেছে। মুভিটি দেখার শেষে মনে হবে- হারিয়ে যাওয়াটাও কখনো কখনো ততটাও খারাপ নয় যতটা আমরা ভাবি, কারণ হারিয়ে গেলেই কখনো কখনো নতুন কিছুর প্রাপ্তি ঘটে। ‘অভিষেক বচ্চন’ এর পাশাপাশি ‘দৈবিক বাঘেলা’ বা বিল্লুর অভিনয় ছিল সাবলীল ও উপভোগ্য। জীবনের গভীরতা নিয়ে ভাবতে ভালোবাসলে এক ফাঁকে একটু সময় নিয়ে দেখতে পারেন মুভিটি।