ডায়েরিঃ আগস্ট ২৫, ২০২৫ঈ ॥ ১০১ দিন
পৃথিবী তার নিজস্ব নিয়মে চলছে। সূর্য ওঠছে, আবার নিয়ম মেনে অস্ত যাচ্ছে; রাত নামছে, ফের ভোর আসছে; মানুষ আসছে-যাচ্ছে, বাঁচছে-মরছে; সবকিছু আগের মতোই চলছে। কিন্তু আমার কাছে পৃথিবীর রূপ আর আগের মতো নেই। পৃথিবীটাকে আমি আর আগের চোখে দেখতে পারি না। কারণ এই পৃথিবীতে জীবনধারণের ধরণ বদলে গেছে। সম্পর্কের ধরন পাল্টে গেছে, বিশ্বাসের ভিত্তি নড়ে গেছে, আর ভরসার জায়গাগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে।
আমি ভেবেছিলাম- কষ্ট গুলো ধীরে ধীরে মুছে যায়, সময়ের সাথে সাথে ক্ষতস্থান শুকিয়ে আসে। কিন্তু বাস্তবতা আমাকে অন্য শিক্ষা দিয়েছে। কষ্ট আসলে কখনোই মুছে যায় না, ম্লান হয়ে বিবর্ণও হয় না; বরং সময় তাকে আরও প্রকট ভাবে দৃশ্যমান করে তোলে। যত দিন যায়, কষ্ট তত গভীরভাবে হৃদয়ে গেঁথে বসে। ক্ষণিকের আঘাত সময়ের প্রবাহে গাঢ় ক্ষতচিহ্নে পরিণত হয়, আর সেই দাগ চিরস্থায়ী হয়ে যায়।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস, ভরসা আর সম্মান- যা একসময় আমার কাছে অবিচল সত্য মনে হয়েছিল; এখন ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, মানুষকে সহজভাবে বিশ্বাস করা ছিল মস্ত ভুলের একটি। আমি যাদের কাছে আদর্শ খুঁজি, যাদের চোখে সাধুতা দেখি, তাদের ভেতরে আসলে এমন কিছু নেই। সবাই প্রয়োজনের খাতিরে সাধু হয়, আর প্রয়োজন ফুরোলেই সাধু ভং ধরা মুখোশটা খুলে কুটিলতায় ভরা প্রকৃত মুখটি প্রকাশ করে। মানুষের এই দ্বিমুখী চরিত্র এত কাছ থেকে না দেখলে হয়ত কখনো বিশ্বাস করতাম না।
এই অল্প কয়েকদিনে জীবনের আরেকটি কঠিন সত্যও উপলব্ধি করেছি। যে সকল মানুষের হৃদয়ের ভেতর কুটিলতা ভর করেছে, যাদের হৃদয় কালশিটে ময়লা পড়ে পচে গেছে, যাদের চিন্তাধারায় কুটিলতা আর অনিষ্ট ছাড়া ভিন্ন কিছু কাজ করে না; তাদের সাথে আপনি যতই ভালো ব্যবহার করেন না কেন, যতই ধৈর্য ধারে সহ্য করে সমস্যার সমাধান খুঁজতে চান না কেন, কোনো লাভ নেই। তাদের স্বভাব পাল্টায় না, পাল্টাবার নয়। এদের মোহর লাগানো হৃদয়ের কথাই ওপরওয়ালা আমাদের বলেছেন, বিধাতার হুকুম ছাড়া এই মোহর আর কখনোই পরিষ্কার হবে না। বরং এই কুটিলতায় পূর্ণ নরকের কীট গুলো খুঁজে খুঁজে আপনার দুর্বলতা বের করে আপনাকে আরও গভীর সমস্যায় ফেলে দেবে।
আমার শূন্য হয়ে পড়া পৃথিবীটার বয়স আজ ১০১ দিন। ঠিক ১০০ দিন পূর্বে আমার আম্মা এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে আপন শান্তির নিবাস খুঁজে নিয়েছেন। দিন হিসেবে ১০০ দিন খুব নগণ্য হলেও এই ১০০ দিনের পৃথিবী আমাকে এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে, যেখানে নেই মায়ের মমতা, নেই সেই নির্ভরতার ছায়া। আছে কেবল ভান করা মায়া, সমাজের সামনে যাত্রা-নাটক প্রদর্শন করার মতো ভদ্রতা, আর স্বার্থের ফাঁদে জড়িয়ে থাকা সম্পর্ক। এই ১০০ দিনেই ‘পরিচিত’ আর ‘কাছের’ নামধারী সম্পর্ক গুলো চোখের পলকেই গিরগিটির মত নিজ নিজ রঙ বদলে নিয়েছে।
আমি কখনো ভাবিনি আম্মা আমাদের এত দ্রুত ছেড়ে চলে যাবেন। আমি ভেবেছিলাম আম্মা অন্তত আরও বিশটি বছর আমাদের সঙ্গে থাকবেন। আম্মার ছায়াশীতল মমতা আমাদের আগলে রাখবে, তার ভরসার আঁচল আকাশ হয়ে থাকবে মাথার উপরে। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু থেমে গেল। যে মানুষটির অবলম্বনে ভরসার স্তম্ভ ভেবে নিয়েছিলাম, তিনি হঠাৎ করেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। আর তার অনুপস্থিতি আমার হৃদয়ে এক বিশাল অবিশ্বাসের দেয়াল তুলে দিল।
আজ মনে হয়, ছোটবেলা থেকে যে মূল্যবোধের শিক্ষা পেয়েছিলাম, সেগুলো আসলে বাস্তব জীবনে অকার্যকর। সততা, নীতিকথা, সত্য-বচন -এসব আঁকড়ে ধরে আমি শুধু পিছিয়েই পড়েছি। আর চারপাশের মানুষগুলো নিজেদের স্বার্থের জন্য কোনোকিছু করতে দ্বিধা করেনি। এই ১০০ দিনে আমি দেখেছি রক্তের সম্পর্কও কেমন করে বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায়। যাদের একসময় নিজের বলতে শিখেছিলাম, যাদের আপন ভেবে স্বস্তি আর মনের তৃপ্তি বুঝে নিতাম; তারাই স্বার্থ হাসিলে বেইমান হয়ে উঠেছে। মানুষ যে এতটা স্বার্থপর হতে পারে, এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, এত বড় মাপের নিমকহারাম হতে পারে; এমন করে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতাম না।
সব আক্ষেপ, সব হতাশা, সব কষ্ট আর সব বেদনার শেষে আমার একমাত্র প্রার্থনা- মহান আল্লাহ যেন আমার আম্মাকে পরিপূর্ণ শান্তি দান করেন। তিনি যেন হাসরের ময়দানে আম্মাকে হাউজে কাউসারের শীতল পানীয় দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করান। আর জান্নাতুল ফেরদৌসকে আম্মার জন্যে স্থায়ী আবাস হিসেবে ঘোষণা করে দেন।
আমার জীবন আজ শূন্যতায় ভরা। কিন্তু সেই শূন্যতার ভেতরও আমি মায়ের শান্তির জন্য হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে দোয়া করি। কারণ আমার সমস্ত বিশ্বাস, ভরসা আর আশ্রয় এক মানুষেই ছিল -আমার আম্মা। আর আজ তিনি নেই… ১০১ দিন।