বিকেলের রঙে হারানো দিনগুলো...
মনিটরের পর্দায় এই ছবিটা দেখে মনে হল যেন কেউ আমার ভেতরের স্মৃতির দরজাটা আস্তে করে খুলে দিচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই শৈশবের বিকেলগুলো- যখন গরমের দুপুর গুলিতে ভাতঘুম দিয়ে বিকেলের আগে আগে উঠতাম। তারপর বিকেল নামলে পরে যেতাম মাঠের দিকে। চারপাশে শুধু বিস্তীর্ণ সবুজ, দূর-সুদূরে অল্প কয়টিা বাড়ি আর ওপরে অনন্ত নীল আকাশ। মনে হতো, যদি কোনোভাবে ওই আকাশে উঠার সিঁড়িটা খুঁজে পেতাম! ভাবতাম নিশ্চই আকাশের একটা গোপন রাস্তা আছে, যা কেবল আমার চোখে ধরা পড়ে না!
প্রতিদিন বিকেলে ঝাঁকে-ঝাক পাখি উড়ে যেত দক্ষিণ দিগন্তে। তাদের দেখেই মনে হতো, তারা নিশ্চয়ই কোনো অদ্ভুত জগতে যাচ্ছে- যেখানে মানুষের অনুমতি নেই, শুধু ডানাওয়ালাদের রাজ্য সেখানে। আমার কৌতূহল ছিল আকাশের চেয়েও বড়; ভাবতাম, একদিন আমিও এমন দুটো ডানার মালিক হবো, উড়ে যাবো তাদের সঙ্গে, তাদের সেই গোপন রাজ্যে!
তবে বিকেলের প্রতি আমার ছোট্ট একটা অভিমানও ছিল। কেন হঠাৎ করেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে? এত সুন্দর আলো, এত রঙ, এত বাতাস, বাতাসের শন্-শন্ -সবকিছু এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায় কেন? কি হতো সন্ধ্যাটা কম হলেও বিকেলটা আরও একটু বড় হলে? কি হতো এই মুক্ত বাতাসে আরও একটু সময় পেলে? মনে হতো, নিষ্ঠুর প্রকৃতি ইচ্ছে করেই আমার বিকেলের সময়টা কমিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু কবে যেন সেই বিকেলগুলো হারিয়ে গেলো, বুঝতেই পারিনি। পড়াশোনা, ব্যস্ততা, জীবনের দৌড়ঝাঁপ- সব মিলে বিস্তীর্ণ মাঠগুলোও ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেলো কালের গহ্বরে। যে মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশের রঙ বদলানো দেখতাম, সেখানে এখন শুধু ইট-কংক্রিটের দেয়াল। এলোমেলো মুক্ত বাতাসের তোড় এখন আর শন্-শন্ গান শোনায় না। আকাশ আছে, কিন্তু তার ম্লান রঙ এখন আর হৃদয় রাঙ্গায় না; আলো আছে, কিন্তু তাতে সেই শৈশবের যাদু এখন অনুপস্থিত।
এই নগরে এখন বিকেল মানেই মানুষের ক্লান্ত মুখ, গাড়ির অসহনীয় শব্দ, ধোঁয়া আর ছুটে চলা মানুষের ভিড়, কোলাহল, আর ময়লার গন্ধ। পাখির ঝাঁকের দেখা এখন আর মেলে না, দেখা যায় কেবল কাটা তারের মাঝে আটকে থাকা কিছু ঘুড়ি, আর দূর আকাশে উড়তে থাকা চিল অথবা কোন বাড়ির উঁচু ছাদের কার্নিশে ক্লান্ত কাক। আমার ভেতরে এই বিকেল গুলিতে এক অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করে- মনে হয়, আমি শুধু আকাশটাই হারাইনি; বরং নিজেকেও হারিয়েছি টুকরো টুকরো সময়ের সাথে।
তবুও, মাঝে মাঝে মনে অদ্ভুত এক ইচ্ছা জাগে। যদি একদিন কৈশরের সেই দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া যেত! আবার যদি সেই বিস্তৃত মাঠে দাঁড়িয়ে রঙ ভরা আকাশের নিচে পাখির অদৃশ্য সেই রাজ্যের পানে গন্তব্য নিয়ে গল্প বানাতে পারতাম। যদি পারতাম শন্-শন্ শব্দের তোড়ে বাতাসে হাত মেলে খোলা মাঠে এলোমেলো ছুটতে। যদি আবার জমা রাখতে পারতাম প্রকৃতির কাছে আমার ছোট ছোট সেই অভিমান আর অভিযোগ গুলো!
বিকেলের রঙ গুলো হয়ত আজও একই আছে, কিন্তু আমি জানি- শহরের আকাশে সেগুলোর দেখা পাওয়া আর সম্ভব নয়। শুধু মনেই রয়ে গেছে মুক্ত মাঠের এক কোনায় দাঁড়িয়ে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখা একখণ্ড রঙিন আকাশ। যেখানে আমি এখনো দাঁড়িয়ে আছি- এক জেদি স্বপ্নবাজ শিশু হয়ে, ডানা গজানোর অপেক্ষায়।
ছবি-সূত্রঃ r/painting